সেন্টমার্টিন ভ্রমণ কাহিনী

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। যার অপর একটি নাম হচ্ছে নারিকেল জিঞ্জিরা। বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত এই স্বপ্নের নীলাভ দ্বীপটি।

এত সুন্দর একটা দ্বীপ আমাদের দেশে যে আছে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। এই দ্বীপের চতুর্দিকে শুধু নীল আর নীল। উপরে নীল আকাশ, নিচে তারই প্রতিচ্ছবি জলের শরীরে।

সরকারি সিটি কলেজের বন্ধুদের ( রুবেল, সাইফুল, খোরশেদ, আকাশ, সাইফুল,ধর্মতিলক বড়ুয়া,মিজান,ফাহিম ) নিয়ে ৩১ডিসেম্বর ২০১৯ গিয়েছিলাম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে।

এই প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে দুই রকমের পর্যটক আসে। কেউ কেউ সেন্টমার্টিন এসে ঐদিনই ফিরে যায়। আবার কেউ কেউ রাত্রি যাপন করে। যারা দিনে এসে দিনই চলে যান তাদের দেখার সুযোগ খুব কম। কিন্তু যারা রাতে থাকেন তাদের জন্য রয়েছে অপার সুযোগ। আমরা ছিলাম সেন্টমার্টিন এসে ঐদিনই ফিরে যাওয়ার পর্যটক। কিন্তু আমার বন্ধুরা সবাই মিলে দুইদিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কক্সবাজার থেকে দুইদিক দিয়ে টেকনাফ যেতে পারে। একটা লিংক রোড দিয়ে এবং অপরটি মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে।আমরা কক্সবাজার এর লিংক রোড দিয়ে টেকনাফ গিয়েছিলাম। টেকনাফ হতে সকাল নয়টার দিকে জাহাজ ছেড়ে যায় এবং বিকাল তিনটায় ফিরে আসে।

টেকনাফ হতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথটি মন্দ নয়। সাড়ে নয়টার দিকে জাহাজ ছাড়ল। নাফ নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে আপনমনে যাচ্ছে জাহাজ। একদিকে বাংলাদেশ, আরেক দিকে মিয়ানমার। মাঝখানে জাহাজে করে যাচ্ছি আমরা। এ যেন দারুণ এক অনুভূতি!

খানিক পরই কুয়াশার জাল সরিয়ে উঁকি দিল চনমনে রোদ। খুশিতে নেচে উঠল মন। গাঙচিলের ঝাঁক অন্য রকম আনন্দ এনে দিল। জাহাজের সঙ্গে নেচে নেচে উড়ে আসছে ওরা। যেন আমরা ওদের অতিথি। আমাদের এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে।

অনেক দূর পর্যন্ত গাঙচিলগুলো আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল। তারপর সাগরের মৃদু ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলতে লাগল জাহাজ। দূরে ঢাউস নৌযানে টহল দিচ্ছে কোস্টগার্ড। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট ছোট সাম্পান। ভয়ানক দুলুনি উপেক্ষা করে হৃষ্টচিত্তে মাছ ধরছেন জেলে ভাইয়েরা। আর মাছগুলো হাতে নিয়ে আমাদের দিকে দেখাচ্ছে আর আমরাও হাত দিয়ে তাদের সম্বোধন জানাচ্ছিলাম।ঘণ্টা দুয়েক পর ধোঁয়াটে নীলচে কিছু চোখে পড়ল। ওটাই সেন্টমার্টিন। আরও মিনিট বিশেক পর অথই জলে বুক চিতিয়ে থাকা প্রবাল দ্বীপে পা পড়ল। সে অদ্ভুত এক শিহরণ!

সেন্টমার্টিনে এখন পর্যটন মৌসুম। চারদিকে গিজগিজ করছে পর্যটক। চলো চলো সেন্ট মার্টিন—এমন একটা ঢল। ঘাট থেকে রাস্তার দুই পাশে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ। সব কটাতেই বুভুক্ষের দল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রতিটি রেস্তোরাঁর সামনে থালায় রয়েছে রকমারি সামুদ্রিক মাছ, মসলায় মেরিনেট করা। ফরমাশ দিলেই মুচমুচে ভাজা মাছ হাজির হবে। ভাজা মাছের সুবাসে জিবে জল এসে গেল। তবে মুখে কিছু দেওয়ার আগে রিসোর্টে গিয়ে ব্যাগগুলো রাখতে হবে। হাতমুখ ধোয়ার ব্যাপার আছে।

জাহাজ ছাড়তেই দেখা যায় চারদিকে গাংচিল। জাহাজের ক্যাপ্টেন যখন আপনমনে জাহাজ ছেড়ে দে তখন গাংচিলদের বিভিন্ন রকমের খাবার দিতে পর্যটকদের ভিড় হয় বাহিরের বেলকনিতে।

গাংচিল দেখতে দেখতে  ২০/২৫ কিলোমিটারের ভ্রমণ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই কেটে যায়।মনে হয়েছিল ভ্রমণটা মুহূর্তেই কেটে গেছে। আর দূর সাগরের নীলাভ অথৈ পানির মাঝে যখন সবুজে ঢাকা দ্বীপটি আমার আর আপনাদের দৃষ্টিগোচর হবে সারা রাতের দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে এক নিমিষেই। এই নীলাভ দ্বীপটি যতই নিকটে আসতে থাকে আপনার ব্যকুলতা ততই বাড়তে থাকবে। ইচ্ছে করবে যেন সাগরে ঝাপ দিয়েই চলে যাই নীল সৈকতে। দ্বীপে পা দিয়েই বুঝতে পারবেন একে নিয়ে মানুষ কেন এতো মাতামাতি করে, কেনইবা একে বলা হয় সুন্দরের নীলাভ লীলাভূমি।

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝে অসংখ্য প্রবাল মিলে মিশে একাকার হয়ে তৈরি করেছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন । সাগরের সুনীল জলরাশি আর নারকেল গাছের সারি এই দ্বীপকে দিয়েছে অপার সৌন্দর্য। প্রকৃতি দু’হাত মেলে সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে এখানে। বালুকাময় সৈকত, প্রবালের প্রাচীর আর কেয়া গাছের সারি এই দ্বীপকে দিয়েছে আলাদা এক বৈশিষ্ট্য যা আর কোথাও নেই।

উত্তাল সাগরের নোনা জল যখন আছড়ে পরে কেয়া গাছের ফাঁকে, ঝিরি ঝিরি বাতাসে তৈরি হয় সফেদ ফেনা, সে এক মাতাল করা দৃশ্য। রাতের জোৎস্না এসে যখন লুটোপুটি খায় চিকচিকে বালুর বুকে, নীল আকাশ তখন আরও নীলাভ হয়। সুনসান নীরব রাতে চারদিকে শুধু সাগরের হুংকার আর ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার গর্জন। অপূর্ব, অসাধারণ, অদ্ভুত সুন্দর, অসহ্য সুন্দর। হাজারো জোৎস্না রাতের চেয়েও সুন্দর সেন্টমার্টিনের একটি নির্ঘুম চাঁদনী রাত, এখানে সময়ের কাটা এগিয়ে চলে কিন্তু সৌন্দর্য পিপাসার তৃষ্ণা মেটে না। তাই এই সুন্দর রাতটা আমি আকাশ,ধর্মতিলক, সাইফুল নির্ঘুম রাত জেগে কাটালাম। সাথে অনেক অপরিচিত লোকজনের সমাগম ঘটেছিল এই রাতে। কেউ যুগলে কেউবা বন্ধুমহল হয়ে আবার কেউ বা একাকী হয়ে নির্ঘুম রাত জেগে কেটেছে। অসংখ্য নারকেল গাছ, কেয়া গুল্ম আর সবুজ বনানী এই দ্বীপকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। পুরো দ্বীপ ঘুরলে মনে হবে নারকেল বাগান এটি। এই নারকেল গাছগুলো পর্যটকদের জন্য যেন হয়ে আছে ছায়া মাখা আর মায়া মাখা কোনো বৃক্ষ।আপনি চাইলে অর্থের বিনিময়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারেন নারকেল জলে। এখানে হাজার তিনেক লোকজনের বসবাস।সেন্টমার্টিন দ্বীপটি চারভাগে বিভক্ত উত্তর পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, মধ্যে পাড়া এবং ছেঁড়া দিয়া। গ্রামের সংখ্যা বেশি উত্তর পাড়া এবং মধ্যে পাড়াই। সেন্টমার্টিন দ্বীপের সিংহভাগই জনগণ মুসলমান। খুবই ধার্মিক ও সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ এরা। তাই কোনো প্রকার চুরি ছিনতাইয়ের সম্ভাবনা নেই এখানে। গভীর রাত পর্যন্ত আপনি জোৎস্না স্নান করতে পারেন নির্বিঘ্নে।

এটি সত্যিই একটি ভিন্ন প্রকৃতির দ্বীপ। এর একদিকে যেমন প্রবাল প্রাচীর ঘিরে রেখেছে, অন্যদিকে বালুকাময় সৈকত প্রহর গুনছে আপনার অপেক্ষায়। সমুদ্রজলে অনায়াসেই আপনি সেরে নিতে পারেন স্নানের কাজটি। এই সৈকতের লাল কাকড়া আর নুড়ি পাথর আপনাকে নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করবে। অবচেতন মনেই আপনি কুড়িয়ে নেবেন বিভিন্ন রং আর ঢংয়ের নুড়ি পাথর, সঙ্গে ঝিনুক খণ্ড।  

এখানে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি হোটেল, মোটেল ও কটেজ রয়েছে। ব্লুমেরিন, অবকাশ পর্যটনসহ বেশ কয়েকটি উন্নতমানের হোটেল রয়েছে। কটেজগুলোও চমৎকার। কটেজের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতেই উপভোগ করতে পারবেন সাগরের মায়াবীরূপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আরেকটি বিষয় হচ্ছে বিদ্যুৎ জটিলতা। এখানে যতদূর সম্ভব দেখেছি বিদ্যুৎ থাকে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা কিংবা ছয়টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত। সুতরাং আপনাদের এই বিষয়টি মাথায় রেখে যাবতীয় মোবাইল, ইলেকট্রনিক জিনিস চার্জ দিয়ে থাকবেন। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বলতে আমরা অন্যভাবে মাছের ঘাঁটি হিসেবে জানতে পারি। এখানে হাজারো নাম জানা, অজানা মাছের দৃশ্য চোখে পড়ে। আর এখানকার তাজা রুপচাঁদা মাছের ফ্রাই আপনার জিহ্বায় জল আনবেই। চাইলে জেলেদের কাছ থেকে তাজা মাছ কিনে এনে হোটেলে ভেজে নিতে পারেন। আর একটি বিখ্যাত জিনিস এখানে পাবেন, সেটা হলো শুটকি। নানা প্রজাতির মাছের হরেক রকম শুটকি পাওয়া যায় এখানে। খুব সহজে ও সুলভ মূল্যে এখান থেকে শুটকি সংগ্রহ করতে পারেন।

দ্বীপের শেষ মাথায় সরু লেজের মতো আর একটি অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ রয়েছে, যার নাম ছেঁড়াদ্বীপ। এই ছেঁড়া দ্বীপে আমরা সবাই সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম। সাইকেল নিয়ে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম আমরা সবাই।আর আমি প্রথমেই ছেঁড়া দ্বীপে পৌঁছিয়ে যায় এবং আসার সময়ও প্রথম। অদ্ভুত এই ভীষণ মূহূর্ত বন্ধু সাইফুল মিস করেছিল সাইকেল চালাতে পারে না বলে। যারা সাইকেল চালাতে পারে না তারা সুন্দর এই দৃশ্য মিস করলেও তাদের জন্য ভিন্ন রকমের ভ্যান আকৃতির রিকশা আছে,যার মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়া যাবে। সুতরাং আপসেট থাকার প্রশ্নই আসে না। তারপরেও সাইকেল চালিয়ে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কেননা সাইকেল চালিয়ে চারদিকের বিভিন্ন প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা এবং উপভোগ করা খুব সহজতর হয়। সাইফুল বাদে আমরা সবাই ছেঁড়া দ্বীপে গিয়েছিলাম। দুই ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে ফের সেন্টমার্টিন দ্বীপে আসি।

জোয়ারের সময় পানি এসে এটিকে মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বলেই এর নামকরন করা হয়েছে ছেঁড়াদ্বীপ। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে এটি আবার মূল দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়। তখন পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় সেখানে। এখানে কোনো বসতি নেই। এই অংশটি একেবারেই প্রবালময়। এখানে স্বচ্ছ জলের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজার ধরনের প্রবাল। এই প্রবালের খালি পায়ে হাঁটলে পা কাঁটার সম্ভাবনা খুব বেশি। নানা রংয়ের মাছেরা খেলা করে প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে। সত্যিই সে এক দেখার মতোই দৃশ্য।

বাংলাদেশে যতগুলো দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা রয়েছে সেন্টমার্টিন তার মধ্যে অন্যতম এক নীলাভ প্রবাল দ্বীপ। এই দ্বীপটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার এর মতোই এবং প্রস্থে কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। টেকনাফ উপজেলা থেকে ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সেন্টমার্টিন। যতদূর জানি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নাকি ১৯৮৩ সালে ইউনিয়ন হিসেবে উন্নীত হয়। ৮ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট সেন্টমার্টিনের দৈর্ঘ্য প্রায় চার কিলোমিটার আর প্রস্থ দুই কিলোমিটার। পূর্বে এর নাম ছিলো নারিকেল জিঞ্জিরা। ৭ম-৮ম শতাব্দীতে সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরব বণিকরা জাহাজযোগে আকিয়াব ও রেঙ্গুন যাতায়াতের সময় এ দ্বীপে সাময়িক বিশ্রাম নিতেন। আরবি শব্দ জাজিরা অর্থ দ্বীপ। এ দ্বীপে প্রচুর নারকেল গাছ রয়েছে। প্রায় ত্রিশ হাজার নারকেল গাছ রয়েছে বলে এলাকাবাসীদের ধারণা। সে থেকেই এটি নারিকেল জিনজিরা হিসেবেই পরিচিত হয়ে আসছিলো।

সেন্টমার্টিন ভ্রমণ কাহিনী

লিখেছেনঃ 

রাইয়ান মোহাম্মদ লোকমান

এমবিএ (ব্যবস্থাপনা বিভাগ)

সরকারি সিটি কলেজ,চট্টগ্রাম।